ডেইলি বাংলা টাইমস :


প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-২২ ১২:৪৯:৩৭




ডেইলি বাংলা টাইমস :


প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-২২ ১২:৪৯:৩৭




সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যা

ত্রাণের জন্য হাহাকার

ত্রাণের জন্য হাহাকার


ঈদের আগের রাত থেকেই পানিবন্দি। দেখতে দেখতে ঘরেও পানি। বুক সমান পানি ঘরে রেখে স্থানীয় ফেদারগাঁও আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন কোম্পানীগঞ্জের সমতেরা বিবি। সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। সমতেরা জানালেন, ঈদের পরদিন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। এর আগের দু’রাত বাড়িতে থাকার সময় অভুক্তই ছিলেন। স্কুলে আসার পর শুকনো খাবার পেয়েছেন। এরপর রান্না করা খাবারো পাচ্ছেন। আইসিটি পার্কের আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন অর্ধশতাধিক পরিবার। বাঁচার মতো খাবার পাচ্ছেন তারা।


কিন্তু অনেকেই শেষ সম্বলটুকু ধরে রেখে বাড়িতেই পড়ে আছেন। কেউ খাটের উপর, আবার কেউ কেউ মাচা বেঁধে বসবাস করছেন। তারা পড়েছেন নানাবিধ সংকটে। খাগাইল এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, যারা বাড়িতে রয়েছেন তারা অনাহারে-অর্ধাহারে বসবাস করছেন। পেছনের কয়েকটি গ্রামের অবস্থা করুণ। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। ত্রাণ পৌঁছাতে হলে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এ কারণে অনেকেরই কাছে খাবার পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠা লোকজনের মধ্যে খাবার নিয়ে স্বস্তি থাকলেও যারা বাড়িতে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তারা পড়েছেন নানা সংকটে। খাবার, পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট তীব্র হয়েছে। এবারের দ্বিতীয় দফা ঢলে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ। এই উপজেলায় ৪২টি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ১৬৪০ জন। কিন্তু লক্ষাধিক মানুষ বাড়িতেই পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। পাশের উপজেলা গোয়াইনঘাট। এই উপজেলাও ঈদের দিন থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।


সিলেটের একমাত্র উপজেলা যেটি সিলেট থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ওই উপজেলায়ও ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৬৭৬ জন। কিন্তু উপজেলার ৯৯ ভাগ মানুষই বাড়িতে রয়ে গেছেন। ঈদ মৌসুমে ঘরে কিছুটা খাবার মজুত থাকলেও এখন ফুরিয়ে আসছে। ফলে উপজেলার প্রান্তিক পর্যায়ে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে খাবার সংকট চলছে। উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন জানিয়েছেন, আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার দিচ্ছি। আর বাড়ি বাড়ি যারা আছেন তাদের মধ্যে শুকনো খাবার দেয়া হচ্ছে। উপজেলার সব চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা ত্রাণ কার্যক্রমে রয়েছেন। যতটুকু সম্ভব আমরা ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছি। সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় দফার বন্যায় সিলেটে ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এর মধ্যে নগরীতে বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার মানুষ। সিলেট নগরীর ২৯টি ওয়ার্ডসহ ১৩টি উপজেলায় ১০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬১ জন মানুষ পানিবন্দি। এর মধ্যে সিলেট নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৯টি ওয়ার্ডের ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। ৭১৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ২৮ হাজার ৯২৫ জন। ১৩টি উপজেলায় ১৫৫২টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।


এদিকে, গতকাল সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে- জেলার ১৩টি উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। সিলেটের সুরমা অববাহিকায় পানি কিছু কমলেও কুশিয়ারা অববাহিকতায় পানি বেড়েছে। ভারত থেকে আসা বরাক নদীর ৮০ শতাংশ পানি ধারণ করছে কুশিয়ারা। এ কারণে জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এখন বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলা। গ্রামীণ সব রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, দুপুর ১২টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর অমলসীদ পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার ও শেওলা পয়েন্টে পানি ৫ সেন্টিমিটার এবং একই নদীর ফেষ্ণুগঞ্জ পয়েন্টে ১০৩ ও শেরপুর পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বেশি পানি কমছে সুরমা অববাহিকায়।


তিনি বলেন, এখনই পুরোপুরি বলা যাবে না বন্যা পরিস্থিতি সার্বিকভাবে উন্নতি হচ্ছে। তবে একাংশে উন্নতি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ফের অবনতি হতে পারে। সিলেট নগরে পানি কমছে। সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, নগরের ৫৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৮ হাজার মানুষ উঠেছেন। তাদের মধ্যে রান্নাকরা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। পানি কমলেও এখনো লোকজন বাড়ি যাওয়ার উপযোগী হয়নি। এ কারণে কেউ বাড়ি যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলে দু’একদিনের মধ্যে লোকজন বাড়ি যেতে পারে বলে জানান তিনি। মেয়র জানান, বন্যায় আক্রান্ত নগরসহ গোটা এলাকা। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দুর্যোগ ও ত্রাণ এবং পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী সিলেট সফর করেছেন। সিলেটের বন্যার্ত মানুষের যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা সবাই মাঠে কাজ করছি। আশা করছি বৃষ্টি কমে গেলে দুর্যোগ আর থাকবে না।


২০ নদী খননের আশ্বাস পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর: বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সবধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে সিলেট নগরীর ক্বীনব্রিজ সুরমা নদী পরিদর্শনকালে  পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আগামীতে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি সে লক্ষ্যে আমরা আলোচনা করেছি। ইতিমধ্যে সুরমা নদীর ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১২ কিলোমিটার খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বন্যার পানি কমে গেলে বাকিটুকু খনন করা হবে। এ ছাড়াও সামগ্রিকভাবে সুরমা-কুশিয়ারা নদী খনন করবো। সুনামগেঞ্জর ছোট-বড় ২০টি নদী আমরা খনন করবো। 


৬ জনের মৃত্যু: গোয়াইনঘাটে পৃথক ঘটনায় ৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন যুবক, শিশু, কিশোর রয়েছেন। গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার বিছনাকান্দি ইউনিয়নের হাদারপার বাজার সংলগ্ন উপরঘামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নাজমিন আক্তার নামে এক কন্যা সন্তানের মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় উপজেলার বিছনাকান্দি এলাকায় বিদুৎস্পৃষ্ট হয়ে জুয়েল মিয়া নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। বন্যার পানিতে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে এ দুঘর্টনা ঘটে। একইদিন বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে সলিল সমাধি ঘটে মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন নামে এক যুবকের। তিনি উপজেলার ফতেহপুর ১ম খণ্ডের শিব্বির মিয়ার ছেলে। গতকাল নগরের মুক্তিচকে বন্যার পানিতে সাতার কাটতে গিয়ে অভি নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার জৈন্তাপুরে মারা গেছে এক শিশু। এ ছাড়া জকিগঞ্জে ঢলের পানিতে তলিয়ে গিয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। 


সুনামগঞ্জে কমছে উজানের পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ: এম.এ রাজ্জাক, সুনামগঞ্জ থেকে জানান, সুনামগঞ্জে গত দুইদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় উজানের পানি কমলেও বাড়ছে দুর্ভোগ। পৌর শহরের ড্রেনের পানি ছড়িয়ে বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ার ফলে পচা দুর্গন্ধ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। গতকাল সকাল থেকে পৌর শহরের রাস্তাঘাট থেকে পানি নদীতে নামলেও বিভিন্ন উপজেলার বাড়িঘরসহ রাস্তাঘাট থেকে ধীরগতিতে পানি নামছে। জেলার ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, শান্তিগঞ্জ, তাহিরপুর, মধ্যনগর উপজেলার মানুষ এখনো পানিবন্দি হয়ে আছেন। তাদের এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে ছোট নৌকার বিকল্প নেই। শুক্রবার সকাল থেকে সুনামগঞ্জের আকাশে কড়া রোদ উঠেছে এবং গরম পড়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বৃষ্টি এবং উজান থেকে পাহাড়ি ঢল না আসায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাত না হলে বড় বন্যার আশঙ্কা আর থাকবে না। তখন নদ-নদীতে স্বাভাবিক পানি থাকবে।


সরজমিন শুক্রবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, তাহিরপুর সদর থেকে জেলা শহরে যাওয়ার সড়ক শক্তিয়ারখলা নামক একশ’ মিটার সড়কটির মধ্যে এখনো কোমর পানি। পথচারীরা ঝুঁঁকি নিয়ে নৌকা অথবা কোমর পানি ভেঙে চলাচল করছেন। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার একশ’ মিটার সড়কের পাশে বসবাস করা নাজমা বেগম বলেন, গত ৫ দিন পর বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে। রাস্তায় এখন হাঁটু পানি রয়েছে। বন্যার সময় কোমর পানি ছিল। শুক্রবার কড়া রোদের দেখা মিলেছে। এ কয়দিন ছোট ছোট বাচ্চাসহ তারা পানির মধ্যেই ছিলেন। এখন রোদ এবং বৃষ্টি কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। পৌর শহরের তৈমুর বলেন, ড্রেনের পচা পানি শহরে ছড়িয়ে পড়ায় গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। গন্ধে শিশুসহ বয়স্করা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। দোয়ারাবাজার উপজেলার সুমন বলেন, পানি ধীরে ধীরে কমছে। গত দুইদিন ধরে নদীতে ঢল না আসায় এলাকার মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছেন।


সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার মানবজমিনকে বলেন, ‘গত দুইদিন ধরে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। যদি চেরাপুঞ্জিতে আবার বৃষ্টি বৃদ্ধি পায় তাহলে আবার একই অবস্থা হতে পারে। তিনি বলেন, আগামী কয়েকদিন বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুরমার পানি ১৭ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি শ্যামল বণিক বলেন, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন পানি কমে যাওয়ায় তারা বাড়ি ফিরে গেছেন।









মন্তব্য